দূর্গাপূজা মানেই ছুটি, মজা হুল্লোর দেদার আনন্দ। আমাদের পাড়ায় বিশ্বাস বাড়িতে দূর্গাপূজা হতো, নবমীর দিন হতো ছাগ বলি। বেশ মনে আছে লোকে ভীড় জমাতো সেই দৃশ্য দেখার জন্য। ছয় সাত বছরের শিশু মনে একটাই প্রশ্ন কেন ওকে বিনা দোষে মেরে ফেলা হচ্ছে, মন জুড়ে শুধু আহারে ওর তো খুব লাগবে। নিরাপরাধ আসামী তখন মনের সুখে কচি বট পাতা চিবোচ্ছে, মাঝে মধ্যে গলার জবার মালটিকেও নিঃশেষ করতে চেষ্টা করছে।নির্লিপ্ত নিরাসক্ত জীবনের শুরু শেষ সবতেই উদাসীন। ফিরতি পথে মনে হতো পুলিশ ধরে নিয়ে যাক ঐ কালো লোকটিকে। কেন ও ছাগ বাচ্চকে মেরে ফেললো, হায় রে শিশু মন কি করে বুঝবে দূর্বলের বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে চিরকাল।
নবমীর ধূনুচি নাচ আর দশমীর মায়ের বিসর্জন সবটাই বন্ধুরা একসাথে মজা করতাম। নিজেরাই আলোচনা করতাম দেখ মা যেন কাঁদছে। আসলে মায়ের কাছ থেকে শিখেছিলাম দূর্গা ঠাকুর মানে মা। আমাদের ছোটবেলায় দূর্গা পূজা মানে ছিল সার্বজননী দূর্গোৎসব, এখনকার ম্যাডোক স্ক্যোয়ারে আড্ডায় গাঁজার ধোঁয়ায় গডেস দূগ্গা নয়।
সারা ভারত জুড়েই পূজা হয় আমাদের এবং উওর ভারতে যা নব রাত্রি দক্ষিণ ও পশ্চিম ভারতে চার হাতের দূর্গা মা সন্তোষি। শরৎকালের এই দূর্গাপূজা রামায়ণ মতে শ্রীরাম চন্দ্রের অকালবোধনের দূর্গা পূজা। কালে কালে সেই পূজাই হয়ে ওঠে বাংলার সার্বজনীন দূর্গাপূজা।
দূর্গা পূজোর সময় সর্বত্র দশরকমের মৃত্তিকা লাগে। যার মধ্যে বেশ্যাদ্বার মৃত্তিকা অপরিহার্য। মানুষের কামবিষ আর লালসাকে নীলকন্ঠের মত গণিকারা ধারণ করে তাঁরা যে সমাজকে কলুষতা থেকে বাঁচতে সহয়তা করে, তার জন্যই তাদের এই সন্মান প্রদর্শন। এ জন্যই তাঁরা ছিলেন জনপদবাসিনী, আসলে দূর্গা পূজা মানে সকলকে নিয়ে,বঞ্চিত, নিপীড়িত, অবেহেলিত সকলের সম্মন্বয়ে সার্বজনীন।
শাক্তসম্প্রদায়ের একটি তন্ত্রশাস্ত্র গুপ্তসাধনা তন্ত্রে নবকন্যার উল্লেখ পাওয়া যায়, যা তাদের কর্মপদ্ধতি অনুসারে নির্ধারিত হয়েছিলো। এই নবকন্যা গুলি হল নর্তকী/নটী, কাপালিক, পতিতা, ধোপানী, নাপিতনী, ব্রাহ্মণী, শুদ্রাণী, গোয়ালিনী, মালিনী। মা দূর্গার পূজা পদ্ধতি যেহেতু শাক্তদর্শন ও শাক্তসম্প্রদায়ের আধারে সৃষ্টি হয়েছে তাই শাক্তসম্প্রদায়ে চিন্হিত নবকন্যার প্রতিক স্বরূপ তাদের দ্বারের মাটি নেওয়া হয় প্রতিমা গড়তে। এখানে শুধু পতিতার দ্বারের মাটি নয় বাকি আরো অষ্টমকন্যার দ্বারের মাটি অপরিহার্য। এছাড়াও সপ্ত নদী, ৫১শক্তিপিঠ এবং পঞ্চম প্রাণীর দেহবশেষ প্রতিমা গড়ানোর কাজে ব্যাবহৃত হয়।
সভ্য সমাজে পতিতাকে ঘৃনার চোখে দেখা হয়। যার জন্য প্রতিমা গড়ানোর কাজে পতিতার দ্বারের মাটি অনেকে ব্যবহার করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করে কিন্তু নবকন্যার দ্বারের মাটি ছাড়া দূর্গা প্রতিমা পূর্ণতা পায় না, কারণ শাক্তদর্শন এখানে পূর্ণভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে না। “বেশ্যার দ্বারে মাটি ছাড়া দূর্গাপূজা সম্পন্ন হয় না”। সভ্য সমাজে পতিতাকে ঘৃনার নজরে দেখা হলেও তার দ্বারের মাটি নেওয়া অপরিহার্য হয়ে যায়।যেহেতু শাক্তসম্প্রদায়ের চিন্হিত নবকন্যা একটি ভাগ পতিতা ও মা দূর্গা যেহেতু সমস্ত নারীশক্তির প্রতিক তাই এখানে পতিতাকেও শুদ্ধ ধরা হচ্ছে।
এই দূর্গা পূজায় আমরা একটু চেষ্টা করলেই সকলের ভালোভাবে পূজাকাটবে। দরকার একটু প্রচেষ্টা। গতবছর এক বিখ্যাত পূজা প্যান্ডেলে প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যেও আকছার সেলফি তুলতে ব্যস্ত দেখা গেছে মর্ডান প্রজন্মকে -গডেস দূর্গা পিছনে # উইথ গডেস দূর্গা। কিন্তু বাধা হয়ে দাঁড়ায় সামনে দর্শনরত তুলনামূলক সাধারণ ও বয়স্ক মানুষজন। মন্তব্য ভেসে আসে “ডিসগাসটিং, কোথা থেকে যে উঠে আসে?”
আমারা কেন ভুলে যাই পূজোতো সকলের। ঝরের গতিবেগে ছুটন্ত বাইক পথচলতি তরুণীদের উদ্দেশ্যে ভাসিয়ে দেয় অশ্লীল শব্দের মোড়কে নোংরা মন্তব্য। আমরাতো নারী শক্তির আরাধনা করছি, তার জন্যেই তো উৎসব, নারীদের সম্মান কবে করবো আমরা?
“অতি বড়ো বৃদ্ধপতি সিদ্ধীতে নিপুণ
কোনোগুণ নেই তার কপালে আগুন”
ঈশ্বরী পাটনিকে মা তার স্বামীর পরিচয় দিচ্ছেন,দ্ব্যর্থক ভাষায়। কিন্তু সাধারণত বাপের বাড়ীতে এসে মেয়েরা যেমন স্বামীর বিরুপতার ঝাঁপি খুলে বসে মাও সেটাই বলছেন সরল পাটনি সেটাই ভাবছে।
দশমীতে মায়ের ভোগ পান্তাভাত কচু শাক। ঘরের মেয়ে বাপের ভিটে ছেড়ে শ্বশুর বাড়িতে চললো। গেরস্থ মা, বাপের বাড়ির শাক পান্তাটুকু মুখে দিয়ে যাক, না জানি কখন আবার চাট্টি খাবার মুখে দেবে।
এই আমাদের দূগ্গা ঘরের মেয়ে প্রাণের দেবী।
মা তুই চিন্ময়ী রূপ ধরে আয়
মৃণ্ময়ী রূপ তোর পূজি শ্রী দূর্গে তাই
দূর্গতি কাটিলোনা হায়।……