হোলি নামটা প্রাচীন দৈত্যরাজের বোন ‘হোলিকা’র নামে।অপশক্তির প্রতীক হোলিকার ধ্বংসই এই উৎসবের তাতপর্য।শীতের শেষে,বসন্তের শুরুতে দেব সান্নিধ্য লাভের আশায় পরিচ্ছন্নতার প্রথম পর্যায়ে প্রস্তুতি হিসেবে ধরাপৃষ্ঠে শুকনো ঝরা পাতার আবর্জনা প্রকৃতিদেবী ঘূর্ণিঝড়ে পরিস্কার করে দেন।কীটপতঙ্গ,জঞ্জাল জমা করে হোলিকার চিতা প্রস্তুত করা হয়।পূর্ণিমার আগের দিন সন্ধ্যাবেলায় অনিষ্টকারী কীটপতঙ্গ সহ ধর্মনাশী,শিশুঘাতিকা,হোলির বিনাশ করা হয়।সমাজের স্বাস্থ্যরক্ষার উদ্দেশ্যে যুগযুগ ধরে এই নাটক অনুষ্ঠিত হয়।সমাজে বাড়তে থাকা রোগজীবানুকে চিরতরে অগ্নিদগ্ধ করে মারতে এই অভিনয় বহুকাল ধরে চলে আসছে।হোলির শিক্ষা এটাই।সমাজের শিক্ষা এটাই।
হোলিতে রংখেলার পিছনেও একটা বৈজ্ঞানিক কারণ আছে।বসন্তে সূর্য থেকে তীব্রতর আলো এসে পৌঁছয় পৃথিবীতে।যে আলোর সঙ্গে মিশে থাকে আলট্রা ভায়োলেট রে বা অতিবেগুনি রশ্মি।যে রশ্মি মানব শরীরে প্রবেশ করলে মেলানোমা ক্যান্সার পর্যন্ত হতে পারে।শাস্ত্রমেনে শরীরে হলুদ মেখে বা হলুদ রঙ মেখে হোলি খেললে,শরীরের ত্বকে লেগে থাকা রঙের প্রলেপ বা আস্তরণ,সেই আলট্রা ভায়োলেট রে থেকে ত্বককে রক্ষা করে।দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে।
আজ থেকে পাঁচশো তিরিশ বছর আগে,দোল পূর্ণিমার দিন(১৪৮৬ খৃস্টাব্দ বা বাংলার ৮৯২ বঙ্গাব্দের ২৩ শে ফাল্গুন)সন্ধ্যায়, নবদ্বীপে জন্মগ্রহণ করেন শ্রীগৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যদেব মহাপ্রভু।নিমগাছের নিচে জন্মেছিলেন বলে নাম হয় নিমাই।বৈষ্ণবদের কাছে,এই দিনটি তাই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দিন।খুব পবিত্র দিন।উচ্চারিত হয় -“তৃণাদপি সুনীচেন/তরোরিব সহিষ্ণুনা/অমানীয়া মানদেয়/কীর্তনেয় সদা হরি।” অর্থাৎ তৃণ বা ঘাসের থেকেও নিচু হ’ও।নিজ বা ভিন্ন মতাবলম্বীর প্রতি সহিষ্ণুতা প্রদর্শন ক’রো।সমাজে যারা সম্মান পায়না,তাদের যথার্থ সম্মান প্রদর্শন ক’রো।সদা সর্বদা হরিনামে নিয়োজিত থাকো।
আচন্ডালে হরিনামের মন্ত্র দিয়ে মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য মাত্র ৪৮ বছর বয়সে (১৫৩৪ খৃস্টাব্দ)দেহত্যাগ করেন।
হোলি কোথাও দুদিন,কোথাও সাতদিন কোথাও বা দশদিন ধরে হোলি খেলা হয়।কৃষ্ণের জন্মভূমিতে ১৫ দিন থেকে একমাস পর্যন্ত চলে দোল উৎসব।উত্তরাখণ্ডের কুমায়ূনে ১৫ দিন ধরে কোথাও কোথাও হোলি খেলা হয় বলে জানা যায়।
কলকাতাতেও যে নব্য বাবু সমাজ গড়ে উঠেছিল,দোল বা হোলি উৎসব সেখানেও এক কুলীন উৎসব হিসেবে মর্যাদা পায়।রুপোর রেকাবি থেকে আতর মেশানো আবির ওড়ানো,রুপোর পিচকারি থেকে সুগন্ধী রঙিন জল ছেটানো,গেলাসে রঙিন পানীয় হাতে, ঠুমরি,দাদরা,বেহাগের তালে ইয়ার-দোস্তদের সঙ্গে নিয়ে তাল ঠোকা,এসবের মধ্যে দিয়েই পালিত হত দোল উৎসব।সুশ্রাব্য এবং অশ্রাব্য গানে,উল্লসিত কোলাহলে পাড়া মেতে উঠত।রাস্তায় রাস্তায় কুৎসিত সং ঘুরে বেড়াত।
প্রাচীন ভারতে কামসুত্র পুস্তকে ‘রত্নাবলী’ বা ‘মালতী মাধব’নাটকে দোল উৎসবের উল্লেখ রয়েছে।আল বিরুনির বিবরণেও দোল উৎসবের বর্ণনা রয়েছে।সাবেক কলকাতায় দোল ছিল এক এক ধরণের ক্রীড়া বিশেষ।দোল উপলক্ষ্যে গৃহস্থ বাড়ীতে পুজো হত।তৈরি হত শরবত(ঠান্ডাই এর প্রচলন হয় অনেক পরে),মিঠাই।নবকৃষ্ণ দেবদের শোভাবাজারের বাড়িতে দোলের সন্ধ্যায় হয় চাঁচর উৎসব।দোল পালিত হয় পূর্ণিমার পরের দিন প্রতিপদে।গানের আসর বসতো।গানের শেষে আবির উড়ত।হোলি উপলক্ষ্যে রেকর্ড কোম্পানিগুলি নতুন নতুন রেকর্ড বের করত।কৃষ্ণচন্দ্র দে,কমলা ঝরিয়া,গহরজান,যূথিকা রায়,বেগম আখতার, বড়ে গুলাম আলি সাহেবের গান বেরোত।অন্তত পঞ্চাশের দশকের শেষ পর্যন্ত এই ধরণের নতুন গানের রেকর্ড প্রকাশিত হওয়ার একটা ঐতিহ্য ছিল।আজকাল মেক,মকি,রিমেক,গা-রিরিমেকের যুগে সেসব কথা বড় বিশ্বাস করতে সাধ জাগে।ফিরে পাবোনা জানি,তবু স্বপ্ন সাধা চলতেই থাকে।ঐ মহাসিন্ধুর ওপার হতে।